
আবু সাইদ, সাতক্ষীরা : ‘আকাশলীনা’ পাল্টে দিয়েছে কলবাড়ির চিত্র। বাংলাদেশের জন্য মডেল হতে পারে শ্যামনগরের এই ইকোট্যুরিজম সেন্টারটি।
সুন্দরবনে মাছ ধরা, মধু সংগ্রহ, কাঠ এনে বিক্রি করা এসব নানান ‘জঙ্গুলে’ পেশায় নির্ভরশীল ছিল কলবাড়ির অধিকাংশ মানুষ। অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় দিন
চলত অনেকের। আর্থিক দুরবস্থা এতোটাই সংকটাপন্ন ছিল যে, পুরো গ্রাম তন্নতন্ন করে খুঁজলেও দু’একটি মটরসাইকেল পাওয়া ছিল দুষ্কর। সুন্দরবনের বাঘের পাশাপাশি বনদস্যুদের আতংক নিয়েই রাত কাটত কলবাড়ির মানুষের। তাই সন্ধ্যার আগেই সবাইকে ঘরে ফিরতে হতো।
কিন্তু আজ মধ্যরাত পর্যন্ত রাস্তা-ঘাটে থাকছে লোকজন। চলছে যানবাহনও। প্রত্যেক ঘরেই এখন মটরসাইকেল। বাইরের পর্যটকরাও এসে ঘুরছেন, দেখছেন প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য সুন্দরবনের দৃশ্য। কেউ কেউ রাতযাপন করেও রাতের সুন্দরবন অবলোকনের সুযোগ পাচ্ছেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এমন পরিবর্তন এনে দিয়েছে ‘আকাশলীনা’।
হ্যা, বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাসের ঐতিহাসিক কবিতা ‘আকাশলীনা’। আজ থেকে শতবর্ষ আগে যে কবি লিখেছিলেন,
‘সুরঞ্জনা,
ওইখানে যেও নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা।’
কবি মনের কল্পিত চরিত্র হলেও যে সুরঞ্জনাকে নিয়ে কবিতাটি লেখা হয়েছিল তার বাস্তব রূপ দিতেই বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে সুন্দরবনের কোলঘেঁষে গড়ে উঠেছে ‘আকাশলীনা’ ইকোট্যুরিজম সেন্টার। দূরত্ব যতই হোক অন্তত সড়ক পথে গিয়ে সুন্দরবন দর্শনের সুযোগ এটি ছাড়া বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। আর সেজন্যই ‘আকাশলীনা’ ইকোট্যুরিজম সেন্টারে প্রতিদিন আসছেন শত শত দর্শনার্থী। শুধুমাত্র গেল ঈদ-উল-আযহার ছুটিতেই প্রায় ১০ হাজার পর্যটক গিয়েছেন সেখানে। দিন যতই যাচ্ছে আকাশলীনা ইকোট্যুরিজম সেন্টারের পরিচয় ততই বাড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও প্রতিদিন যাচ্ছেন পর্যটকরা।
স্থানীয় বুড়িগোয়ালিনি ইউপি চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বললেন, আকাশলীনা ইকো ট্যুরিজম সেন্টারটি এলাকার শ্রীবৃদ্ধি করেছে। গোটা সুন্দরবনকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নকেও পরিচিত করে তুলেছে এই আকাশলীনা। আর এর মাধ্যমে গোটা বাংলাদেশকেও বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে তোলা সম্ভব।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার একেবারে দক্ষিণে বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নেরই একটি গ্রাম কলবাড়ি। খুলনা থেকে ১২২ কিলোমিটার দূরে হলেও অন্তত সড়কপথেই যাওয়ার সুযোগ রয়েছে সেখানে। তবে খুলনা-মুন্সিগঞ্জ ও যশোর-মুন্সিগঞ্জ রাস্তার ব্যাপারে সরকারের মহাপরিকল্পনারও দাবি উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে সেখানে বেড়াতে যাওয়া নওয়াপাড়ার সিরাজুল ইসলাম বললেন, রাস্তাঘাটের যে দুরবস্থা তাতে দৃষ্টিনন্দন এমন স্থাপনার শৈল্পিকতাই হারিয়ে যাবার আশংকা রয়েছে। এজন্য তিনি অবিলম্বে যেসব স্থানে রাস্তা খারাপ রয়েছে সেগুলো সংস্কারের দাবি জানান। বিশেষ করে খুলনা থেকে মুন্সিগঞ্জ
যাবার পথে কয়েকটি স্থানে খানা-খন্দের সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চুকনগগর থেকে আঠারোমাইল, সাতক্ষীরার আগে ও পরে এবং শ্যামনগর থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তা এতোই খারাপ যে, কেউ ওই রাস্তা দিয়ে একবার গেলে দ্বিতীয় বার আবার ফিরে আসতে চায় না। অথচ সড়কপথে খুলনা থেকে মাত্র দু’ঘন্টার পথ এটি। কিন্তু রাস্তা খারাপ থাকায় সময় লেগে যাচ্ছে প্রায় পাঁচঘন্টা।
আকাশলীনা ইকোটুরিজম সেন্টারটি স্থাপিত হয় সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে। যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ছিলেন শ্যামনগরের তৎকালীন উপজেলা
নির্বাহী অফিসার আবু সায়েদ মো: মনজুর আলম। যিনি বর্তমানে খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৫ সালের ৪ এপ্রিল আকাশলীনার কার্যক্রম শুরু হলেও গত বছর (২০১৬) ১৯ নভেম্বর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো: আবদুস সামাদ।
আকাশলীনায় রয়েছে ট্রেল, জেটি ও নদী ভ্রমণের জন্য রয়েছে ইকো বোট। দূরের পর্যটকদের জন্য রয়েছে আবাসিক ব্যবস্থাও। প্রতিদিন আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে রয়েছে থাকার ব্যবস্থাও। এজন্য রয়েছে ছয় জনের ধারণ ক্ষমতার একটি কটেজ। জোয়ার ক্যান্টিন বাঁদাবনের হেঁসেল নামের একটি রেস্টুরেন্ট যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে পার্কিং, ছোট যাদুঘরসহ পর্যটকদের জন্য হরেক রকম সুবিধা। মালঞ্চ নদীর গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা কেওড়া বাগানের মাঝেই সেন্টারটি স্থাপন করা হয়েছে। কাঠ-বাঁশের ব্রীজ দিয়ে শিল্পের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা ওই সেন্টারের কোথাও বসার জায়গা কোথাও ফিস মিউজিয়াম আবার কোথাও নদীতে নামার জন্য তৈরি হয়েছে সরু সিঁড়ি পথ। রয়েল বেঙ্গল ওয়াচ টাওয়ার, কেওড়া আনন্দ বাড়ি, পিকনিক কর্ণার, চিলড্রেন কর্ণার, মুক্তমঞ্চ, ফিটনেস সেন্টার, সুইমিং পুল এসব কিছুর পরিকল্পনা নিয়েই এ সেন্টারটি তৈরি হয়েছে।
প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ১০ টাকা প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকছে সেন্টারটি।
মুন্সিগঞ্জ বাজার রোড আর কলবাড়ি রোডের মধ্যবর্তী স্থানে স্থাপিত এ ট্যুরিজম সেন্টারটি হতে পারে বাংলাদেশের একটি মডেল। সরকারিভাবে এমন প্রতিষ্ঠান খুব কম চোখে পড়ে উল্লেখ করে সেখানে ঘুরতে যাওয়া সাতক্ষীরার একজন মাদরাসা শিক্ষক কাজী ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, এটিকে ধরে রাখতে সরকারের আরও বেশকিছু পরিকল্পনা নেয়া দরকার। এর মধ্যে পার্শ্ববর্তী স্থানে সরকারিভাবে হোটেল-মোটেল নির্মাণ এবং খুলনা ও যশোর থেকে যাতে পর্যটকরা সহজে সেখানে যেতে পারে সেজন্য রাস্তাঘাটের সংস্কার জরুরি।
নিলডুমুরের বাসিন্দা খুকুমনিসহ ছয় বোন তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গিয়েছিলেন আকাশলীনায়। সেখানে গত বুধবার কথা হয় এ প্রতিবেদকের সাথে। তারা জানান, পাশেই তাদের বাড়ি। কিন্তু এর আগে কখনও এখানে আসার সুযোগ হয়নি। আসার মত পরিবেশও ছিল না। এখন ট্যুরিজম সেন্টার হয়েছে বলে পরিবার-পরিজন নিয়ে অবসরে ঘুরতে আসা।
টাঙ্গাইলে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরী করেন আসাদুজ্জামান নুর নামের এক ব্যক্তি। তিনিও মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা। বাইরে থাকায় এলাকায় ছুটিতে এসে ঘুরে বেড়ানোর তেমন সুযোগ হয়না। গত ঈদ-উল-আযহার ছুটিতে তিনি বাড়ি এসে গিয়েছিলেন আকাশলীনায়। বললেন, ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা
ওই গ্রামে। কিন্তু এমন শৈল্পিক দর্শনীয় স্থাপনা যে হতে পারে সেটি আগে বিশ্বাস ছিল না। এটি তার এলাকার জন্য বিরাট পাওয়া বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ট্যুরিজম সেন্টারের মধ্যে ঝালমুড়ি, আমড়া, বাদাম বিক্রি করেন শেখ জিয়াদ আলী ও জহুর আলী সরদার। তারা বললেন, এ এলাকায় আগে লোক আসত না। ভয় হতো, বাঘের-দস্যুদের। কিন্তু এখন তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ আসছে দেশ-বিদেশ থেকে। এলাকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হচ্ছে।
কলবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মো: শফিকুল ইসলাম মিলন বললেন, আকাশলীনা ইকোট্যুরিজম সেন্টার এলাকার চিত্র পাল্টে দিয়েছে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে। এর বাইরেও বেশকিছু হ্যাচারী ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এলাকার মানুষকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।
শ্যামনগরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: কামরুজ্জামান বলেন, শ্যামনগর একটি পর্যটনবান্ধব উপজেলা। এ উপজেলায় প্রায় ৪০টি প্রাচীন স্থাপত্য ও দর্শনীয় স্থান আছে। আকাশলীনা প্রকল্পটির ফলে পর্যটকরা এসকল স্থাপত্য ও দর্শনীয় স্থান সহজে ভ্রমণ করতে পারছে। এছাড়া সুন্দরবনভিত্তিক জীবিকা অর্জনকারীদের জন্য আর্থ সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি তাদের কর্মসংস্থানও তৈরী হয়েছে। পর্যটন মৌসুমে (অক্টোবর-মার্চ) প্রতিদিন ৩/৪ হাজার পর্যটক আকাশলীনা ভ্রমণ করে। এছাড়া অন্যান্য সময়ে আনুমানিক এক হাজারের বেশি পর্যটক প্রতিদিন ভ্রমণ করে।
দিন দিন আকাশলীনায় ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে সেন্টারের ম্যানেজার মো: সাইফুল ইসলাম জানান, বর্তমানে প্রতিদিন ৬/৭
হাজার পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করছে। আকাশলীনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আয় হয়েছে। গত ঈদ-উল-আযহায় আয় হয় ৮০ হাজার টাকার উপরে। এছাড়া প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয় বলেও তিনি জানান।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো: মহিউদ্দিন বলেন, ‘সাতক্ষীরার আকর্ষণ সড়কপথে সুন্দরবন’ এ শ্লোগান নিয়েই মূলত সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন এগিয়ে যাচ্ছে। এজন্য সাতক্ষীরাকে পর্যটন জেলা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার অংশ হিসেবেই শ্যামনগরের সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু সায়েদ মো: মনজুর আলমের চেষ্টায় আকাশলীনা তৈরি হয়। এটি একটি ইনোভেশন ইন পাবলিক সার্ভিস। এর বাইরেও জেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে দর্শনীয় স্থান। দেবহাটায় রূপসী দেবহাটা, আশাশুনিতে কেওড়া পার্ক, তালায় গোপালপুর ইকোপার্ক, বাকালে ডিসি ইকোপার্ক করা হচ্ছে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি ট্যুরিজম সেন্টার করারও পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে পর্যটকরা অন্তত: একইসাথে একাধিক স্থাপনা ও পর্যটনকেন্দ্র দেখার সুযোগ পায়। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। কথা হচ্ছে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাথেও। তবে এজন্য সহজ যোগাযোগের বিষয়টি অন্তরায় বলেও স্বীকার করেন জেলা প্রশাসক।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সাথেও কথা হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও সড়কের বিষয়টি মন্ত্রীর দৃষ্টি
আকর্ষণ করা হয়। খুব শীঘ্রই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।